যুদ্ধ শেষে ইউক্রেন নিয়ে তুরস্কের পরিকল্পনা
চলমান রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে অনেকে ভাবা শুরু করেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার পর ইউক্রেন পুনর্গঠন কীভাবে হবে। গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া নগর, শহর ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের জন্য ৭৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন।
নিঃসন্দেহে এ যুদ্ধে তুরস্ক অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হতে চলেছে। মস্কো ও কিয়েভ—উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে আঙ্কারা। তুরস্কের মধ্যস্থতায় গত মার্চ মাসে ইস্তাম্বুলে আলোচনায় বসে দুই পক্ষ। কিয়েভসহ কয়েকটি অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় রাশিয়া। জুলাই মাসে ইস্তাম্বুলে রাশিয়া, ইউক্রেন ও তুরস্ক একটি খাদ্য চুক্তি করে। এর ফলে ইউক্রেন কৃষ্ণসাগর দিয়ে লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছে। এ চুক্তি তুরস্কের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আঙ্কারা এখন দুই দেশের কাছ থেকেই সস্তায় খাদ্যশস্য কিনতে পারছে।
কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে তুরস্ক। ১৮ আগস্ট লিভিভে তুরস্কের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ইউক্রেনের অবকাঠামোবিষয়ক
মন্ত্রীর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তুরস্ক এখন থেকে ইউক্রেনের অবকাঠামো পুনর্গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। তুরস্কের একটি কোম্পানি ইউক্রেনের বুচা ও ইরপিনের সঙ্গে কিয়েভের সংযোগ স্থাপনকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু পুনর্নির্মাণের কাজ পেতে যাচ্ছে। এ ঘটনার শক্তিশালী ও প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ সমাপ্তি কিংবা যুদ্ধবিরতি চুক্তির আগেই তুরস্ক যদি এ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে, তাহলে রাশিয়া যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে, এটা তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
সম্প্রতি তুরস্কে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন তুরস্কের ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাইকার ইউক্রেনে তাদের কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। সেটি যদি সত্যিই ঘটতে যায়, তাহলে বলতে হয়, আঙ্কারা এমন কিছু জানে, যা বাকি বিশ্ব জানে না। রাশিয়ার সেনাবাহিনী ড্রোন কারখানায় হামলা চালাবে না—তুরস্ক যদি মস্কোর কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা না পায়, তাহলে এত ব্যয়বহুল কোনো প্রকল্প তারা করতে যাবে না।
যুদ্ধের এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এ ধরনের কিছু ঘটা অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে তুরস্ক এখন যা করছে, সেটাই করে যাবে। অর্থাৎ রাশিয়ার সঙ্গে তুলনামূলক সুসম্পর্ক রক্ষা করে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করে যাবে। এভাবেই যখন উপযুক্ত সময় আসবে, তুরস্কের ব্যবসায়ীরা রাশিয়ার হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইউক্রেন পুনর্গঠনের কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন।
আঙ্কারা একটি বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন যে ইউক্রেনের সঙ্গে তাদের সামরিক সহযোগিতা ক্রেমলিনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না। ইউক্রেনের কাছে ড্রোন বিক্রি বন্ধে রাশিয়া কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি। এর মানে হচ্ছে মস্কোর ওপর আঙ্কারার স্পষ্ট আধিপত্য রয়েছে। পশ্চিমাদের কাছ থেকে একঘরে হওয়ার পর রাশিয়া তুরস্ককে ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার করছে এবং আঙ্কারার সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়িয়েছে। বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ইউক্রেনে তুরস্কের প্রতিটি পদক্ষেপ বিষয়ে চোখ বন্ধ করে রাখবে ক্রেমলিন।
রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা ও আন্তর্জাতিকভাবে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃত ক্রিমিয়াকে তুরস্ক নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকা হিসেবে ব্যবহার করতে চায়—এটা কোনো গোপন বিষয় নয়। ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত এই উপদ্বীপ রুশ সাম্রাজ্য কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন যত দিন থেকেছে, তার চেয়ে বেশি দিন থেকেছে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। এ কারণেই ক্রিমিয়া উপদ্বীপের জাতিগত তাতারদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আঙ্কারা আবির্ভূত হতে চায়। তুরস্ক সম্প্রতি ক্রিমিয়ার তাতারদের (যারা তুর্কিভাষী মুসলমান) দীর্ঘ মেয়াদে বসবাসের অনুমতি দিচ্ছে। তুরস্কের আইন অনুযায়ী যে বিদেশিরা দেশটিতে কমপক্ষে আট বছর ধরে বসবাস করছে, তাদেরই এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। আঙ্কারা সম্ভবত ক্রিমিয়ার তাতারদের তাদের নিজের সমাজে একীভূত করে নিতে চায়। আবার একই সঙ্গে ক্রিমিয়ায় যারা বাস করছে, সেই তাতারদের মধ্যেও প্রভাব বাড়াতে চায়।
আঙ্কারা মস্কো ও কিয়েভ—দুই পক্ষের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখছে এবং মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের ভূমিকা বাড়াচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত মার্চ মাসে ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেন আলোচনায় যে মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে শান্তি আলোচনা চালু করতে পারবেন বলে আশা করছেন। যদিও ক্রিমিয়াসহ পুরো ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহার করা না হলে কিয়েভ শান্তি আলোচনায় সম্মত নয়। এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়া যদি ইউক্রেনের কাছে পুরোপুরি পরাজিত হয় কিংবা যেসব এলাকা দখলে নিয়েছে, সেখান থেকে সেনা সরিয়ে নেয়, তাহলেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রকৃত বিজয়ী হিসেবে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারবে তুরস্ক।
যুদ্ধের এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এ ধরনের কিছু ঘটা অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে তুরস্ক এখন যা করছে, সেটাই করে যাবে। অর্থাৎ রাশিয়ার সঙ্গে তুলনামূলক সুসম্পর্ক রক্ষা করে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করে যাবে। এভাবেই যখন উপযুক্ত সময় আসবে, তুরস্কের ব্যবসায়ীরা রাশিয়ার হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইউক্রেন পুনর্গঠনের কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
কোন মন্তব্য নেই